নানাভূত
সে অনেক আগের কথা। আমার মা তখনও জন্মই নেয় নি। জন্ম নিবে কিভাবে ? নানার তো বিয়েই হয় নি। বিয়ে হবে কিভাবে ? নানার তো বয়সই হয় নি। গল্পটা নানার কৈশোর কালের। নানার এক দুরসম্পর্কের কাকা ছিলেন। সবাই তাকে বাবুর আলী পাগল নামেই চিনত। সে তন্ত্র-মন্ত্র সাধনা করত। তার ঘরে ভয়ানক সব জিনিস দেখা যেত। রাহু চন্ডালের হাড়, মরার মাথার খুলি,শশ্মানের হাড়ি-কুড়ি,আধপোড়া কাঠ,ডাকিনীর মূর্তি,আরও কত কি? সহজে তার ঘরে কেউ ঢুকত না। আপন জগত নিয়ে ব্যস্ত থাকত পাগল।
জিন ভূত নিয়েই ছিল তার কারবার। গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরে কবিরাজি করে বেড়াত পাগল। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করলেও তার প্রধান কাজ ছিল জিন ভূতের আছর ছাড়ানো। একবার কিশোর বয়সী নানার খেয়াল হলো ব্যাটা পাগল, তুমি মানুষের ঘাড় থেকে জিন ভূত তাড়াও। একদিন তোমাকে আমি ভূতের ভয় দেখিয়ে পিলে চমকে দেব।
নানাদের বাড়ি থেকে উত্তর দিকে ছিল শশ্মান। তার নিচে ছিল কূল-কূল বয়ে যাওয়া নদী। খুব সুনসান জায়গাটা । বড়-বড় গাছ-গাছালিতে ঠাসা। দিনেই রাতের মত ঘুটঘুটে আঁধার হয়ে থাকত। একা তো নয়ই দু’তিন জন মিলে দিনের বেলায় যেতেও গা ছম-ছম করত।
এই শশ্মান আর নদীর মাঝখান দিয়ে ছিল রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই বাবুর আলী পাগল দূর গাঁ থেকে কবিরাজি করে রাতে বাড়ি ফিরত। রাস্তার পাশেই ছিল একটা বড় গাবগাছ। পরিকল্পনা মতো নানা একদিন সাঁঝের আগে থলেয় করে ধূলি, ছাই ও ঢিল নিয়ে গাব গাছের উপর উঠে গেলেন। সন্ধ্যা হলো চারিদিকে কালো জমাট অন্ধকার। আশে-পাশের গাছ গুলোতে নানা প্রজাতির পাখি এসে বসে কিঁচির-মিচির করে ডাকতে লাগল। নিচে ঝিঁ-ঝিঁ পোকারা একটানা গলা সাধতে লাগল।
খানিকবাদে চাঁদ উঠল। পথ ঘাট আলোয় ঝলমল করে উঠল। গাবগাছটার নিচে পড়ে থাকল মিশমিশে কালো ছায়া। নানা অপেক্ষা করতে লাগলেন। কখন ব্যাটা পাগল আসে। চাঁদটা মাথার উপর উঠার একটু আগে দেখা গেল সাদা কাপড় পরে, ঝোলা কাঁধে, মাথায় মার্কিন কাপড় বাঁধা পাগল লাঠি হাতে আপন মনে হেঁটে আসছে। পাগল আসছে। নদীর পাড় দিয়ে,শশ্মানের ধার দিয়ে। হেঁটে যাচ্ছে বড় গাবগাছটার নিচ দিয়ে। আচমকা মাথার উপর ধূলি ছাই ও কয়েকটা ঢিল পড়ল। ঢিলগুলো পাগলের কাছ থেকে একটু ফাকে পড়ল। ভাগ্যিস মাথায় পড়েনি। চৈত্র মাসের শুকনো ঢিল। মাথায় পড়লে ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটত। পাগল মোটেই ভয় পেল না। স্থির মনে নানা রকম দোয়া কালাম ও মন্ত্র পড়তে লাগল। না, তাতেও কাজ হলো না। ভূতের তান্ডব বাড়তেই থাকল। তুমুলবেগে ধূলো আর ঢিল পড়তেই থাকল।
পাগল বুঝতে পারল তার মন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে মানে এ কোন জি¦ন ভূতের কাজ নয়। নিশ্চই কোন দুষ্টু মানুষের কাজ। তাকে ভয় দেখানোর জন্যই এই আয়োজন। পাগল গালি-গালাজ শুরু করে দিল। কোন ব্যাটা হতচ্ছাড়া, নেমে আয় বলছি। তোর ভূতগিরি যদি আমি বার না করেছি তবে আমার নাম বাবুর আলী পাগলই নয়। ওদিকে নানার ধূলি, ছাই ও ঢিলের থলে খালি হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে তিনি থেমে গেলেন। পাগল তখনও বকাবকি করেই চলেছে। ব্যাটা বদমাশ, নেমে আয়। এই আমি বসলাম এখানে দেখি তুই কোন দিক দিয়ে যাস। কোন মায়ের ছেলে তুই, আজ না দেখে ছাড়ছিনে।
নানা মগডালে বসে আছেন । পাগল চলে গেলেই নেমে বাড়ি চলে যাবেন। কিন্তু একি! ব্যাটা পাগল তো নড়ে না,চড়ে না। দিব্যি গাছের গোড়ায় বসে আছে। রাত গভীর হতে লাগল। চাঁদ মাথার উপর থেকে পশ্চিমে হেলে পড়তে লাগল। নানার পেটে ক্ষুধার চোটে ছুচোর নাচন শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। নানা আবার নিচে তাকালেন। হতাশ হলেন পাগল ব্যাটা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। উঠবার নাম তো নেই-ই,নড়াচড়াও করছে না।
নানা ভাবলেন এখন কী করা যায়। কোন কুক্ষনেই যে পাগলের সাথে লাগতে গেলাম। এখনতো ধরা খেয়ে উত্তম মাধ্যম খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যা হবার হবে আল্লাহ ভরসা বলে নানা নামতে লাগলেন। নানা নামতে নামতে গাছের গোড়ার দিকে মাটির কাছাকাছি চলে এলেন। দেখলেন পাগল দূরে তাকিয়ে চুপটি করে বসে আছে।
নানা পাগলের মন নরম করার জন্য দরদভরা কন্ঠে ডাকলেন। কাকা, ও কাকা। পাগল খুব স্বাভাবিক স্বরে বললেন, কে? ও আজাহার। আয়,আয়, নেমে আয়। অনেক রাত হয়েছে বাড়ি চল। আশ্বাস পেয়ে নানা যেই লাফ মেরে মাটিতে নেমেছেন। অমনি পাগল খপকরে নানার কানধরে বললেন তবে রে হতচ্ছাড়া, পাজি, তোর ভূতগিরি বার করছি চল, বাড়ি চল। নানার মুখের অবস্থাটা তখন যদি তোমরা দেখতে বুঝতে ভয়ে তার কী দশা হয়েছিল।
আহমেদ টিকু,
হাজি জামাল উদ্দিন কলেজ,
ডাকও উপ. ভাঙ্গুড়া,জেলা:পাবনা।
০১৭২৩৮৮৬০৩৩,০১৯২২৯৭৪৮৪৫
0 মন্তব্যসমূহ