রহিমুদ্দিন ফজরের নামাজ আদায় করে মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে হাসিমুখে বললেন,
- ময়না, মা আমার খুবই
লক্ষ্মী। ঘুম থেকে উঠে যাও। বাবা এখনই বের হব। আমাকে সাতটা চুমু দেবে না!
একথা বলে মিটিমিটি হাসেন আর মেয়ের মুখের
দিকে তাকিয়ে থাকেন। ময়নার মা রোমেলা বেগম
স্বামীর দিকে বেলা বিস্কুট আর চা বাড়িয়ে
দিয়ে বললেন,
- নাস্তা খেয়ে নাও। ময়নাকে জাগিও না। আরেকটু ঘুমিয়ে নিক। রাতে তোমার জন্য দেরি করে ঘুমিয়েছে। ঘুমানোর জন্য ওকে কতো করে বুঝিয়েছি। কিন্তু না, ওর সেই একই
কথা। বাবা আসলে বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে।
স্ত্রীর কথায় রহিমুদ্দিন মনে মনে হাসলেন। আজ আর কথা
বাড়ালেন না। ময়নাকে ঘুমে আচ্ছন্ন রেখে সাতসকালে রিক্সা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে
পড়লেন।
রোমেলা বেগম আজ দেশি মুরগির
মাংস রান্না করেছেন। অনেকদিন ধরে ময়না দেশি মুরগির মাংস খেতে চেয়েছিল। আজ নয় কাল
করতে করতে প্রায় মাসখানেক সময় কেটে গেছে। ময়নার বাবা গতকাল একটি দেশি মুরগি কিনে সেটি জবাই না করে বাসায়
নিয়ে আসেন। রহিমুদ্দিন জানেন, ময়না পাখি পুষতে ভালোবাসে। জীবিত মুরগী পেলে ও খুব মজা
পাবে। সারারাত ওকে নিয়ে খেলতে পারবে। তারপর কাল ওর মা তা
রাঁধবে।
বাবার হাতে দেশি লাল মুরগী দেখে ময়নার সে কী আনন্দ!
সারাদিন লাল মুরগিটা নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে সে। এটা-ওটা খাইয়েছে। একথা ওকথা বলেছে। ময়না জানে, মুরগী ডাকতে পারে। কিন্তু মানুষের মতো না। নিজের স্বার্থে মানুষ সত্যের পাশাপাশি মিথ্যা কথাও বলে। হয়তো মিথ্যা বলার ভয়েই ওরা মানুষের মতো করে কথা বলে না। আবার সকাল হলেই মানুষের ঘুম ভাঙাতে অবিরাম ডাকতে থাকে।
দুপুর বারোটা বাজার সাথে সাথে ময়নার মা ওর কাছ
থেকে মুরগিটি নিতে আসেন। ময়না মাকে দেখে বলে ওঠে,
- মা, তোমার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে, করব?
- হ্যাঁ, কর না।
- আচ্ছা, মা, মুরগী তো জীব। ওদেরও
তো আমাদের মতো প্রাণ আছে। আমরা যেমন কথা বলি, ওরাও বলে। কিন্তু ওদের কথা আমরা বুঝি না কেনো?
রোমেলা বেগম হেসে ওঠে বললেন,
- শোন মা, আমাদের নিজস্ব ভাষা আছে। ওদের তা নেই। ওরা
আওয়াজ তোলে মাত্র। এই যেমন ধরো,
আমাদের মধ্যেও সবার আওয়াজ আমরা বুঝি না। তবে অঙ্গভঙ্গি দেখে বুঝে নিই।
- তাহলে ওরা কীভাবে দলবেঁধে মায়ের সাথে ছোটে? আর মানুষের ডাকে
সন্ধ্যা হলে কীভাবে নীড়ে ফিরে আসে?
- চমৎকার প্রশ্ন করলে! একটু আগেই তোমাকে বলেছিলাম, আমাদের মধ্যে যারা কথা বলতে পারে না, তাদের মুখের ভাষা আমরা না বুঝলেও তাদের
অঙ্গভঙ্গি দেখে আমরা ঠিকই তাদের বুঝতে পারি। আর হ্যাঁ, প্রাণিকূলের
সবারই নিজস্ব একটা জগৎ আছে। সে জগতে আছে
তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা জীবনযাপনের কৌশল। তারাও আমাদের মতো সফল কিংবা ব্যর্থ হয়। হয়তো আমাদেরকে নিয়ে তারাও এমন কিছু ভাবে। দূর থেকে আমাদের কথা শুনে বিস্মিত হয়।
মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ময়না বলল,
- হ্যাঁ, মা, তুমি একদম ঠিক কথা বলেছো। একটু আগে আমি যখন লাল মুরগিটির সাথে কথা বলছিলাম ও তখন ঠোঁট
নেড়ে বাঁকা চোখে আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে "কুক কুরু কু..." বলে ডেকেছিল। এখন বুঝেছি ও আমার কথা
শুনেই এমনটি করেছে।
- হ্যাঁ, মা, এখন মুরগিটি আমার হাতে দাও। আমি নিয়ে যাই।
- মা, মুরগিকে এখন তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?
- কেনো? রান্নাঘরে।
- তার মানে!
- মানে আবার কী? মুরগিটা আমায় দাও। রান্না করতে হবে। সময় চলে যাচ্ছে।
ময়না লাল মুরগিটা কাছে টেনে নিয়ে বলল,
- না, মা, আমার লাল মুরগিকে তোমায় রাঁন্না করতে দেবো না।
ময়নার এমন আচরণে রোমেলা বেগম রীতিমতো বিস্মিত হয়ে বললেন,
- একি কথা, মা! মুরগী তো খাবার জন্যই
আনা হয়েছে। তাছাড়া তুমিই তো বলেছিলে দেশি
মুরগির মাংস খাবে। তোমার বাবার হাতে টাকা ছিল না। একটু একটু করে জমিয়েছেন। অনেক কষ্ট করে তোমার জন্য মুরগিটি কিনে এনেছেন।
- কিন্তু আমি এটিকে পুষতে চাই।
- এটি পোষা লাগবে না। আর কয়েকঘন্টা পর
তোমার বাবা বাসায় ফিরবেন। আমাদের সুখের জন্য বেচারা সারাটা দিন বাইরে পড়ে থাকেন। রিক্সার প্যাডেল ঘোরাতে কতো শক্তি লাগে তা তুমি বুঝবে
না, মা।
এই কথা বলে রোমেলা বেগম একটানে লাল মুরগিটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। মায়ের এমন আচরণে ময়না মন খারাপ করে
বসে রইল।
অল্প কিছুক্ষণ পর ময়নার বাবা
রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরলেন। কাঁধের গামছাটা টেনে নিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে বাসার দিকে ঢুকছিলেন রহিমুদ্দিন। চিরচেনা মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে আসতেই এক দৌড়ে এসে
ময়না বাবার বুকের ভেতর জায়গা করে নেয়। রহিমুদ্দিন মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বোলাতে থাকেন। একমুহূর্তে তার সারাদিনের খাটুনি যেনো দেহ থেকে উধাও হয়ে গেল। এখন দেহে কোন ক্লান্তি নেই। চোখের কোণে ঘুম নেই। আছে শুধু এক পিতার কন্যার
প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। ময়না বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার কাছ থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে নিজ হাতে বাবার মুখমণ্ডল, গলা, হাত মুছে দিল। তারপর একদৌড়ে ঘরের পিছনের ছোট্ট পুকুরের জলে তা ধুয়ে এনে
উঠোনের রৌদ্রে দিয়ে বাবার পাশে এসে মেঝেতে বসল। বাবা ময়নার এমন আচরণে নির্বাক হয়ে ভাবেন,
- ময়না অনেকটা তার মায়ের মতনই হয়েছে। যতক্ষণ সামনে থাকে ততক্ষণ বাবাকে নিয়ে পড়ে থাকে। ইনিয়েবিনিয়ে বাবার সাথে কথা বলে। একটা দুইটা নয়। সারাদিনে মনের মধ্যে জমে থাকা হাজারো কথা ফটফট করে বাবাকে বলে দেয় সে। কখনও কখনও মায়ের বিরুদ্ধেও নালিশ করে বসে। বাবা তখন ওর মায়ের দিকে
তাকিয়ে মিটমিট করে হাসেন। মা রাগী রাগী
চোখে তাকালে ময়না বাবার খুব কাছে চলে আসে। আর দ্রুত বলতে
থাকে,
- দেখেছ বাবা, তোমার সামনেও কীভাবে তাকাচ্ছে। অথচ আমি তোমাদের দু'জনকেই ভালোবাসি।
ময়নার এমন কথায় বাবা-মা দু'জনেই
হো হো করে হেসে
ওঠেন।
ময়নার বাবা আবার বললেন,
- আমার আম্মাজান কী যেনো বলতে
চেয়ে বলেনি?
রোমেলা বেগম আগ বাড়িয়ে বলতে
লাগলেন,
- আমি বলছি, তোমার মেয়ে লাল মুরগিটি রান্না করতে দিতে চায়নি। আমি অনেকটা জোর করেই রান্না করেছি।
- কী দরকার ছিল! দরকার হলে একবেলা আমরা মরিচ মাখিয়ে খেয়ে নিতাম।
- তুমি আবার এসব কী বলছো! ছেলেমেয়েদের
এতো লাই দিতে নেই। এতে বিপদ হতে পারে।
- ওটা তোমার ভুল ধারণা। আমার ময়না কখনও লাই পেয়ে মাথায় উঠবে না।
এরইমধ্যে ময়না ওর বাবার বুকে
জায়গা করে নিয়েছে।
রহিমুদ্দিন আবার বললেন,
- দেখছো না, আমার মেয়ে সব পরীক্ষায় প্রথম
হয়ে আসছে। এবারও প্রথম হবে। ইনশাআল্লাহ।
রোমেলা বেগম মেঝেতে খাবার রেখে স্বামীকে খেতে দিলেন।
রহিমুদ্দিন বললেন,
- তুমিও বসো।
- না, আগে তুমি খেয়ে নাও। আমি ময়নাকে খাইয়ে দিচ্ছি।
এই কথা বলে রোমেলা বেগম ময়নার খাবার আলাদা বাটিতে নিয়ে নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিতে লাগলেন।
খাবার খেয়ে রহিমুদ্দিন গামছটা কাঁধে তুলে আবার রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ।
রাত নয়টা পর্যন্ত রিক্সা চালালেন। আজ আর রিক্সা
চালাতে মন চাইছে না
তার। বারবার ময়নার কথা মনে পড়ছে। এরপর কাপড়ের গোছা থেকে মানিব্যাগটা বের করে সব টাকা গুনে
দেখলেন। গ্যারেজের টাকা দেয়ার পর একটি মুরগী
কেনার মতো টাকা হয়েছে। তাই রিক্সা নিয়ে সোজা গ্যারেজের দিকে চলে আসেন। গ্যারেজের পাশেই মুরগির দোকান। সেখান থেকে লাল রঙের একটি মুরগী কিনে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন।
নতুন আরেকটি মুরগী পেয়ে ময়না যেনো আনন্দে আত্মহারা। সে একদৌড়ে মায়ের
কাছে গিয়ে বাবার মুরগি আনার খবর পৌঁছে দেয়।
রোমেলা বেগম হাসতে হাসতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- তোমার পাগলামি দেখে আর না হেসে
পারি না। হাতে টাকা-পয়সা নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা যেখানে, সেখানে এতো বিলাসিতা করা নেহায়েতই বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
রহিমুদ্দিন হেসে ওঠে বললেন,
- তুমি সবকিছু উল্টো করে দেখো। আরে আমাদের দশটা নয় পাঁচটা নয়
একটামাত্র মেয়ে। ওর এই সামান্য
ইচ্ছে যদি পূরণ করতে না পারি তো
আমরা কীসের বাবা-মা?
- তাই বলে ও যা চাইবে
তা-ই দিতে হবে!
- কী এমন চেয়েছে! এবার মুরগি এনেছি। দু'জনে মিলে
এটাকে পোষ মানাবে। ক'দিন পর
আমার মামণির জন্য ডিমও পাবে। বিক্রেতা বলেছেন মুরগিটি বর্তমানে নাকি ডিম পাড়ছে।
- তাহলে তো ভালোই হলো।
এ কথা বলে রোমেলা বেগম মুরগিটা নিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
লাল মুরগিটি পেয়ে ময়না যেনো নতুন কোনো সঙ্গী ফিরে পেয়েছে। সারাক্ষণ মুরগিটির সাথে কাটিয়েছে। একটু পরপর মুরগিকে খাবার খাইয়ে আনন্দ অনুভব করছে। ঠিক আগের মুরগিটির মতো অল্প সময়ের মধ্যে ময়না মুরগিটিকে আপন করে নেয়। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ময়নার মা মুরগিটিকে তাদের
শোবার ঘরের পাশে একটি ছোট্ট বাক্সের ভেতর রেখে দেন।
ময়নার বয়স আট। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। খুব মেধাবী ছাত্রী। ইস্কুলের স্যার-ম্যাডামরা ওকে খুব আদর করেন। বরাবরের মতো এবারও সে বার্ষিক পরীক্ষায়
প্রথম হয়েছে। বাবা বলেছেন এবার নতুন পোশাক পরেই ময়না ইস্কুলের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাবে। ময়না একথা তার আশপাশের বন্ধুদের কাছে প্রচার করে বেড়িয়েছে। আর মাত্র দু'দিন পর ময়নার ইস্কুলে
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হবে। পরদিন সকালে রহিমুদ্দিন মেয়ের জন্য পোশাক নিয়েই বাসায় ফিরবেন বলে রিক্সা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ময়না মুরগিটির সাথে মহানন্দে সময় পার করে। একটু পরপর মায়ের কাছে এসে মাকে প্রশ্ন করে বসে,
- মা, বলতে পারো, আমার জামা কেমন হবে? নিশ্চয় বাবা আমার জন্য টুকটুকে লাল জামা আনবেন। আমার পছন্দের কথা বাবা জানেন।
মেয়ের কথায় রোমেলা বেগম মৃদু হাসেন। ময়না মায়ের হাসির মানে বোঝে না। শুধু বাবার আসবার পথ চেয়ে থাকে।
রহিমুদ্দিন সারাদিন রিক্সা চালিয়েছেন। রাত আটটা বাজে। শরীরে আর বল পাচ্ছেন
না। রিক্সা গ্যারেজে জমা দিতে যাচ্ছেন। গ্যারেজের সামান্য দূরে হঠাৎ জ্যাম দেখে উল্টোপথে রিক্সা ঘুরিয়ে এগুতে লাগলেন। হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন। উল্টোপথে রিক্সা চালানোর অপরাধে তাকে মামলার ভয় দেখায় তারা।
রহিমুদ্দিন হাতেপায়ে ধরেও রেহাই পাননি। পুলিশ সার্জেন্ট তাকে মানিব্যাগ বের করতে বললেন। এরপর মানিব্যাগের সব টাকা নিয়ে
তাকে ছেড়ে দেন। সারাদিনের তিলতিল করে কষ্টের টাকা একমুহূর্তে অন্যের হয়ে গেল। পকেটে আর একটি টাকাও
অবশিষ্ট নেই। ময়নার জামা কিনবেন কীভাবে! আর জামা ছাড়া
বাসায় গেলে ময়না নিশ্চয় মন করবে। রহিমুদ্দিনের
ভেতরটা যেনো পুড়ে যাচ্ছে। একমুহূর্তে যেনো সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এরপর গ্যারেজে রিক্সা জমা দিয়ে চরম হতাশা নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন তিনি।
বাবাকে বাসায় পেয়ে ময়না আবার ব্যস্ত হয়ে যায়। গুনে গুনে বাবার গালে-কপালে-চোখে সাতটা চুমু দেয়। কিন্তু প্রতিদিনের মতো আজ বাবার মুখে
কোনো হাসি নেই। হঠাৎ বাবাকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে দেখে ময়না বাবার বুকে আস্তে করে মাথাটা রেখে চোখ বুজে জিজ্ঞেস করলো,
- বাবা, আজ তোমার কোন
সমস্যা হয়েছে! তাই মন খারাপ করেছো।
কী হয়েছে, বাবা?
রহিমুদ্দিন ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলেন,
- মা রে, গরীবের শখের কোনো মূল্য নাই! সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও আমি তোর জন্য নতুন জামা আনতে পারিনি। আমি হেরে গেছি রে, মা!
পাশ থেকে রোমেলা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
- কী হয়েছে তোমার? আর এমন করে
বলছো কেনো?
গলার গামছাটা হাতে নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে
রহিমুদ্দিন বললেন,
- অনেক আশা করে আজ রিক্সা নিয়ে
বের হয়েছিলাম। বেশ যাত্রীও পেয়েছি। মোটামুটি ময়নার জন্য জামা কেনার মতো টাকাও হাতে এসেছিল। কিন্তু---।
- আবার কিন্তু কী?
- বাধ সাধলো পুলিশ সার্জেন্ট। এই গরীবের ওপর
জুলুম করল। মামলার ভয় দেখিয়ে মানিব্যাগের
সব টাকা নিয়ে গেল। আমি পারলাম না।
ময়নাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দু'চোখের জল
ছেড়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন রহিমুদ্দিন। নিজের কচিহাতে বাবার চোখের জল মুছে দিয়ে
ময়না কাঁদো গলায় বলল,
- বাবা, তুমি আর কেঁদো না।
আমার জামা লাগবে না।
একথা বলে ময়না রুমের ভেতরের দিকে চলে যায়। একটুপর বাবা-মা কোনো কিছু
বুঝে উঠার আগে ময়না বাবার সামনে তার পুরনো একটি জামা দেখিয়ে বলল,
- বাবা, এই দেখো আমার
কী সুন্দর জামা! পুরোনো হলে কী হবে! কোথাও
ছিঁড়া নেই। এটা পরেই আমি অনুষ্ঠানে যাব।
ময়নার এমন কথায় রহিমুদ্দিন ওকে বুকে জড়িয়ে আবার কেঁদে উঠলেন। পাশ থেকে রোমেলা বেগম স্বামী ও মেয়ের গায়ে
আলতো করে হাত রেখে চোখের লোনাজল ছাড়লেন।
পরদিন খুব ভোরে লাল মুরগিটি "ময়না! ময়না!" বলে ডাকতে থাকে। অদ্ভুত বিষয় হলো এ ডাক ময়না
ছাড়া আর কারোর কানে
পৌঁছায় নি। ময়না চোখ কচলাতে কচলাতে লাল মুরগিটির কাছে আসে। লাল মুরগিটি ময়নাকে লক্ষ্য করে বলে ওঠে,
- বন্ধু, তোমার কী মন খারাপ?
ময়না বিস্মিত হয়ে বলল,
- এই লাল মুরগী, তুমি আমাদের মতো কথা বলছো কীভাবে! তোমরা তো কথা বলতে
পার না।
লাল মুরগিটি হেসে ওঠে বলল,
- হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছো, মুরগিরা কথা বলতে পারে না। কিন্তু আমি কোনো সাধারণ মুরগি নই। আমি হলাম জাদুর মুরগি। গতকাল তোমাদের সব কথা আমি
শুনেছি। তোমার আর তোমার বাবা-মায়ের কান্না আমি দেখেছি। তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই।
- কী কথা?
- তুমি একটু চোখ বন্ধ কর।
লাল মুরগিটির কথামতো ময়না চোখ বন্ধ করল। অমনি লাল মুরগিটি পরীর বেশে ময়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর সে ময়নাকে চোখ
মেলতে বলল। চোখ মেলে ময়না রীতিমতো অবাক হলো। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে
পারে না। তাই লুকিয়ে নিজেই নিজের গায়ে চিমটি কাটলো। না, সত্যি লাল মুরগিটি পরীর মেয়ের রূপে ওর সামনে দাঁড়িয়ে
আছে। ময়না এদিকওদিক ভালো করে তাকিয়ে দেখল। আশপাশে কেউ নেই। শুধু লাল মুরগিটি ওর সামনে দাঁড়িয়ে
আছে।
ময়নাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাল মুরগিটি বলল,
- ময়না, কী হলো তোমার?
এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
- তোমাকে দেখে অবাক হচ্ছি। মুরগী থেকে মুহূর্তে পরী হয়েছ। এটা কী করে হতে
পারে!
- আমাদের ভাবনার বাইরে অনেক কিছুই হতে পারে। এখন আসল কথায় আসি- তোমার মন খারাপের কারণ
কিন্তু আমি জানি।
- কীভাবে জানো?
- গতকাল তোমাদের সব কথা আমি
বাক্সের ভেতর থেকে শুনেছি। তোমার বাবা অনেক ভালো মানুষ। তোমার জন্য সবই করতে পারেন। কিন্তু নিরুপায় হয়ে ভেঙে পড়েছেন। তাই নিজের আসল পরিচয় তোমার কাছে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন তুমি বল তোমার কেমন
পোশাক চায়?
ময়না হেসে ওঠে বলল,
- আমি তোমার গায়ে যেমন পোশাক আছে তেমন পোশাক চাই।
- তা-ই হবে। আগে
চোখদুটো বন্ধ কর।
পরীর মেয়ের কথামতো আবার চোখ বন্ধ করে ময়না। পরীর মেয়ে মুখে বিড়বিড় করল। অমনি তার হাতে এক সেট পোশাক
চলে আসে। এরপর ময়নাকে চোখ মেলতে বলল। চোখ মেলে ময়না একেবারে থ বনে গেল।
এ কী করে সম্ভব!
পরীর মেয়ে তার গায়ের পোশাকের মতো অবিকল আরেক সেট পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ময়নার হাতে পোশাকটি তুলে দিয়ে পরীর মেয়ে আবার বলল,
- শোন ময়না, আজ এই পোশাক
পরেই তুমি ইস্কুলের অনুষ্ঠানে যাবে। আর হ্যাঁ, আজকের
পর আমি আর তোমাদের সাথে
থাকতে পারব না।
- কেনো?
- এতে আমাদের অমঙ্গল হয়। চিন্তা করো না। আজ চলে গেলেও
তোমার যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে পাশে পাবে।
- কীভাবে!
- যখন আমার সাথে দেখা করতে চাইবে তখন আমার দেয়া এই পরীর পোশাকে
ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ঘষা দেবে। অমনি তোমার ডাকে আমি সাড়া দেবো। আরেকটা কথা, আমার বিষয়ে কারোর সাথে কিছু বলবে না। বললে আমাকে আর কাছে পাবে
না।
ময়না আনন্দের সাথে সায় দিয়ে বলল,
- ঠিক আছে।
এরইমধ্যে পরীর মেয়ে আবার ময়নাকে চোখ বুজতে বলল। চোখ বোজার সাথে সাথে পরীর মেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছু মুহূর্ত পর পরীর মেয়ের
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ময়না
চোখ খুলে দেখে তার সামনে কেউই নেই।

0 মন্তব্যসমূহ