মুমুর সখ
মুমু সকাল থেকে ভেবে রেখেছিল কথাটা বাবাকে বলবে। শেষপর্যন্ত দুপুরে বাবার সাথে খেতে বসে কথাটা বলেই বসল, ‘বাবা, তুমি তো আমাকে কখনো বেড়াতে নিয়ে যাও না কোথাও!’
বাবা মুখে ভাত নিয়ে চিবুতে চিবুতে মুমুর দিকে তাকাল। বলল, কোথায় যাবি?
মুমু ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে বলল, বেড়াতে!... অনেকেই যেমন বেড়াতে যায় বাইরে!
মুমুর বাবা মনিলাল মুখের ভাত চিবুতে চিবুতে তার বছর আটেক বয়সের মেয়েটার কথায় চমকে উঠল। মেয়ের কথার তেমন কোনো জবাব দিতে পারল না। পাশেই বসেছিল মুমুর মা মালতি। সে মুমুকে ধমকে উঠল, এ্যাই মেয়ে, খুব পাকনা হয়েছে না? সারাদিন তোর বাবা বাইরে গাড়ি চালায়। খুব কষ্ট করে বাড়ি ফেরে। কখন নিয়ে যাবে তোকে বেড়াতে?
মুমু মায়ের কথার প্রতিবাদ করে বলে, টিভিতে দেখি ছুটির দিনে কত লোক কত জায়গায় বেড়াতে যায় আমরা যাই না কেন?
মনিলাল প্রাইমারি স্কুলেই পড়াশোনা ছাড়ান দিয়েছিল। বছর কয়েক বাড়িতে খেয়ে গা-হাত-পা একটু লম্বা হলে রিকশা চালানো শুরু করে। উপার্জন ভালো হয় তার। বিয়ে করে সংসারি হলে ঘরে আসে এক ছেলে, ছেলেটা হাইস্কুলে পড়ছে এখন। আর কয়েক বছর পর মুমুর জন্ম হয়। মুমু এখন ক্লাশ থ্রী-তে পড়ে। ছেলেটা তাকে কোনোদিন কিছু না বললেও মেয়েটার কথায় তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিতেই চিন্তাগুলো মাথায় আসে। সত্যি তো, সে ছোটবেলা স্কুলে পড়ার সময় বা পড়া ছেড়ে দিলেও একা একা গ্রামের কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। অথচ এই শহরে এসে তার ছেলে-মেয়ে দুটোকে ঘরে আটকে রেখেছে! একটা দিন নিজে খুশি মনে কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায়নি। মেয়েটার আব্দার তো মিথ্যে না।
শুক্রবার বিকেলে মুমু বাবার সাথে বেড়াতে বেরুল। মনিলাল শুক্রবার খুব সকালে তার রিকশা নিয়ে ভাড়া খাটতে বেরিয়েছিল। তার এলাকার খুব পরিচিত দুজনের দুটো বাচ্চাকে সে প্রতিদিন সকাল আটটায় স্কুলে পৌঁছে দেয় আবার স্কুল ছুটি হলে বাড়িতে রেখে আসে। এতে অবশ্য মাসে দুই হাজার টাকা পায়। আজ স্কুল ছুটি, তাই দুটো ছেলের রিজার্ভ ভাড়া নেই। দুপুর পর্যন্ত টানা খেটে বাড়ি চলে এসেছে সে। উদ্দেশ্য একটাই মুমুকে বলেছিল আজ বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যাবে। ছেলেটা কয়েকদিন থেকে বাড়ি নেই, মামার বাড়ি গেছে। ও থাকলে ওকে সাথে নিত।
মুমু আজ নতুন একটা জামা পরেছে, অবশ্য বাবা হিসেবে মনিলালও ভালো একটা জামা গায়ে দিয়েছে। শহরের প্রতিটি রাস্তা মনিলালের চেনা-জানা। শহরে ইলেকট্রিক চার্জের অনেক অটো/রিকশা থাকলেও নিজের ব্যক্তিগত রিকশাটা সেই আগের নিয়মে প্যাডেল চেপেই চালাতে হয়। এতে একটু কষ্ট হলেও তার ভালোই লাগে। মনিলাল মেয়েকে রিকশার সিটে বসিয়েছে। মুমু রিকশার হুড এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। অবশ্য বাবা মনিলাল রিকশা বেশ আস্তে আস্তে চালাচ্ছে। আজ অন্যের ভাড়ার তাড়া নেই, নিজের মেয়েকে ‘রাজকন্যা’ বানিয়ে শহর বেড়াচ্ছে মনিলাল। মুমুও রিকশায় বসে রাস্তার দুই পাশে তাকাচ্ছে আর বাবাকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করছে। আজ শুক্রবার শহরের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। তাই রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। মনিলাল রিকশাটা আস্তে ধীরে চালিয়ে মেয়েটাকে সবকিছু দেখাতে থাকল।... শহরের কাঁচা-সবজি মাছবাজার, বড় বড় মুদির দোকান, সারি সারি বইয়ের দোকান। অডিটরিয়াম পার হয়ে বিশাল বড় কলেজমাঠ, কলেজের বিল্ডিং, এরপর স্টেশনবাজার এলাকায় রেলস্টেশন। সেখান থেকে ঘুরে রাস্তার বামে এলে বড় বড় খাদ্য গুদাম, ফার্ণিচারের দোকান, গার্লস স্কুল। এখানে এসে মুমু জিজ্ঞেস করল, বাবা, দাদাভাইয়ের স্কুল কোথায়?
মনিলাল ডানদিকে হাত তুলে বলল, ঐ ভেতরে আছে।
মুমু ফের রাস্তার পাশের দিকে নজর দিল। বাবা তাকে কী সুন্দর করে সবকিছু দেখিয়ে-বুঝিয়ে দিচ্ছে।... মুমু এই প্রথম দেখল শহরের বড় বড় দোকানপাট, পুরনো সিনামা হল, বড় একটা মসজিদ। অনেকটা দূর গেলে একটা মোড়ের ওপর স্বাধীনতার স্তম্ভ দেখল খুব আগ্রহ সহকারে। এরপর বাবা তাকে নিয়ে গেল স্টেডিয়ামের সামনে শিশু-পার্কে। রিকশাটা একটা দোকানের সামনে তালা দিয়ে রাখল। শিশুপার্কে যত না বাচ্চা তার চেয়ে বেশি বড়মানুষ! দেখে মুমু অবাক হল। বাবা এক ঠোঙা বাদাম কিনে দিল ওকে। বাবা-মেয়ে একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে বাদাম খেল।
ঐ দেখো একটা রিকশা।... এ্যাই রিকশা যাবে? রাস্তার ধারে রিকশায় অপেক্ষায় ছিল সমবয়সি একটা ছেলে আর মেয়ে। মনিলাল হাসিমুখে বলল, না আপা। আজ ভাড়া খাটব না।
মেয়েটা বলল, কেন ভাই?
মনিলাল পেছনে ঘুরে হাসিমুখে তাকাল। মুমু তার পেছনে একটু সাইড হয়ে বসেছিল জন্য হয়ত মেয়েটা ওকে দেখতে পায়নি। এবার মেয়েটা মুমুকে দেখতে পেয়ে বলল, ও স্যরি। রিকশায় তো যাত্রী আছে দেখছি। মনিলাল হেসে বলল, আমার মেয়ে। মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, আপনার?... খুব সুন্দর করে হেসে বলল, বেড়াতে বের হয়েছেন নিশ্চয়!
মনিলাল হেসে মাথা নাড়ল। মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে বলল, ভাই একটু দাঁড়ান তো।বলেই সে প্রায় দৌড় দিল সামনের একটা দোকানের দিকে। ফিরে এল হাতে একটা কাপ-আইসক্রিম নিয়ে। মুমুর হাতে কাপ-আইসক্রিমটা দিয়ে ঠান্ডা হাতে মুমুর গাল টেনে ধরল, মিষ্টি একটা মেয়ে!
মুমু এই আকস্মিক ঘটনায় একটু লজ্জা পেল। মেয়েটা মনিলালের দিকে চেয়ে বলল, যান বেড়ান। দেখে খুব ভালো লাগল।... আজ আমরা এই আনন্দে হেঁটে বাড়ি ফিরব।
মনিলাল মুমুকে নিয়ে ফের রিকশা চালু করল। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। বেলা পশ্চিমে ডুবে সন্ধ্যে হয়ে এলো। মুমু কাঠের চামচ খুলে আইসক্রিম খেতে থাকল। আজ বাবার সাথে রিকশায় বেরিয়ে ওর মনটা আনন্দে ভরে গেছে। ইস্, প্রতিদিন বিকেলে বাবার সাথে এভাবে যদি ঘুরে বেড়ানো যেত! কিংবা প্রতিদিন না হোক, প্রতি শুক্রবার বিকেলেটা এভাবে কাটানো যেত; তাহলে কী মজাই না হতো!
শিবশঙ্কর পাল, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক।
হাফরাস্তা, নাটোর।

0 মন্তব্যসমূহ