কাকের ছানা কাক্কা
কেবল হাঁটতে শিখেছে রিদা। এখনও পুরোপুরি সামলে হাঁটতে পারে না, টলতে টলতে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে ধপাস করে পড়ে, উঠে আবার হাঁটে। হাঁটা তার এখন একটা খেলা। সে এখন হাঁটা হাঁটা খেলে, আবার খেলতে খেলতে হাঁটে।
হাঁটতে হাঁটতে সে জানালার গ্রিল ধরতে শিখেছে। জানালার ঠিক নিচে একটা টুল পেতে রাখা। রিদা গ্রিল ধরে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে তার কণ্ঠ ছড়িয়ে দেয়। দু-চারটা কথা ফুটতে শুরু করেছে রিদার কণ্ঠে, সে কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়— বাব্বা! মাম্মা! দাদ্দা!
জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পুরো পাড়াকে সে এই নাম ̧গুলো ধরে ডাকে। সব শব্দের শেষে রিদা কেন যুক্ত উচ্চারণ করে তার রহস্য কেউ উদ্ধার করতে পারে না! কেউ সে চেষ্টা করেছে বলেও মনে হয় না! রিদার জানালাটা বাড়ির পাঁচতলায়। জানালার ঠিক পাশেই একটা লম্বা ঝাঁকড়া গাছ আছে। রিদার জানালা থেকে গাছটার একদম উপরের অংশ দেখা যায়। গাছটা জানালার ঠিক পাশেই মানে এতটা কাছে নয় যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়! ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ঠিক ততটা কাছে যতটা হলে সামনের দিকের ডালের প্রতিটা পাতা আলাদা করে গোনা যায়!
জানালায় দাঁড়িয়ে পুরো পাড়াকে ডাকার ফাঁকে রিদার চোখে পড়ে গাছের একটা ডালের গোড়ার দিকে একটা কাকের বাসা। রিদা অবশ্য এখনও পাখির নাম জানতে শুরু করে নি। পাখির বাসা কীভাবে তৈরি হয়, পাখি কেন গাছেই বাসা বেঁধে থাকে তার কিছুই সে এখনও জানতে শুরু করে নি। তবু কাকের বাসার প্রতি তার আগ্রহ কমলো না বা কাকের বাসাকে সে এড়িয়ে গেল না। বরং তার পুরো মনোযোগ কাকের বাসার দিকে পড়ে গেল। কারণ সে দেখল সেখানে দুটো বড় কাকের সাথে দুটো ছোট ছোট ছানাও আছে! ঠিক যেন তার মতোই ছোট আর তুলতুলে ছানা। বড় কাক দুটোর একটি বাসায় ছানা দুটোর পাশে, আরেকটি একটু দূরে একটা ডালে বসে আছে। বড় কাক দুটো ছানা দুটোর বাবা-মা। ছানা দুটো উপরের দিকে মুখ হা করে রেখেছে আর বাসায় থাকা বড় কাক, যে বাবা কিংবা মা যেকোনোটাই হতে পারে, ছানা দুটোর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। কী খাবার তুলে দিচ্ছে তা অবশ্য রিদা বুঝতে পারল না। সে শুধু বুঝতে পারল ছানা ̧লোর মুখে খাবার দিতেই তারা তা গিলে ফেলে।
জানালায় দাঁড়ানো বেড়ে গেল রিদার। জানালায় দাঁড়িয়ে কাকের বাসায় ছানা দুটোকে দেখতে রিদার খুব ভালো লাগে। ছানা দুটোর দিকে সে হাসি হাসি মুখে তাকায়। ইচ্ছে করে তাদের কাছে যায়, তাদের সাথে খেলে। আগে যেভাবে সে পুরো পাড়াকে ডাকত সেভাবে মাঝে মাঝে সে এখন কাকের ছানা দুটোকে ডাকে—বাব্বা! মাম্মা! দাদ্দা!
ডাকে আর জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রাখে কাকের ছানাদের দিকে! কাকের ছানা দুটোও দেখে রিদাকে। সরাসরি নয়, একটু আড়চোখে। রিদাকে দেখলে তাদেরও ভালো লাগে। রিদা জানালায় এলেই তাদের নড়াচড়া বেড়ে যায়। গাছের ডালের বাসা থেকে তারা দেখে জানালার ওপাশে একটা ছানা, তাদের মতোই ছোট আর তুলতুলে! রিদা যেমন কাক বা পাখি সম্পর্কে জানতে শুরু করে নি, কাকের ছানা ̧গুলোও তেমন রিদা বা মানুষ সম্পর্কে জানতে শুরু করে নি। রিদার ডাক তারা শুনতে পায়, সাড়া দিতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারে না। রিদা যতটুকু ডাকতে শিখেছে, তারা ততটুকুও এখনও শিখে নি!
রিদা দেখে কাকের বাবা-মা আসলে হাঁটাহাঁটি করে না, উড়ে বেড়ায়। তাদের ডানা আছে, ডানা মেলে উড়ে উড়ে এখান থেকে ওখানে, যেখানে খুশি যায়। কিন্তু ছানা দুটো তাদের বাসায় কেবল বসে থাকে আর মাথা নাড়ায়। চলাফেরা করে না, উড়ে বেড়ায় না। কাউকে বোঝাতে হয় না, রিদা বুঝে ফেলে নিজেই। কদিন আগে সেও হাঁটতে পারত না, এখনও সেভাবে পারে না, যেভাবে তার বাবা-মা হেঁটে বেড়ায়। রিদার মনে আছে হাঁটা শেখার আগে সে হামা ̧গুড়ি দিত, তারও আগে বিছানায় শুয়ে হাত-পা নাড়াত। কাকের ছানা দুটোও তেমন এখনও উড়তে শিখে নি। রিদা অপেক্ষা করতে থাকে, ছানা ̧গুলো উড়তে শিখলে তাদের সে কাছে ডাকবে! রিদা নিজে যেতে পারবে না, কাকের ছানাদেরই আসতে হবে। পায়ে হেঁটে এই জানালা থেকে কাকের ছানাদের বাড়ি যাওয়া সম্ভব না! উড়ে উড়েই কেবল যাওয়া সম্ভব। রিদা তো আর উড়তে পারে না, পারবে না। উড়তে পারলে যেতে পারত!
কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। রিদা আগের চেয়ে আরও ভালোভাবে হাঁটতে পারে এখন। হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে না! শুধু হাঁটা না, এখন সে ছুটেও বেড়াতে পারে! শুধু মুখের কথা আগের চেয়ে ফোটে নি, আগের মতোই বাব্বা, মাম্মা, দাদ্দা পর্যন্তই আছে! এর বাইরে যদিও দুই-চারটা কথা শোনা যায়, তবে তার অর্থ উদ্ধার করা যায় না! কাকের ছানা ̧লোও বড় হয়ে ওঠে। আগে তাদের গায়ে ছোট ছোট লোম ছিল, চামড়া দেখা যেত, এখন পালক দিয়ে ঢেকে গেছে তা, কালো রঙের পালক। আগে মাথার কাছে লালচে ছিল, এখন সব কালো। ওদের ঠোঁটও ছিল অনেকটা ভোঁতা, মুখের সামনে এখন লম্বা কালো ঠোঁট হয়েছে।
কাকের ছানা দুটো তাদের বাসা এবং আশেপাশে হালকা উড়তে শিখেছে, উড়তে উড়তে এ ডালে ও ডালে ঘুরে বেড়ায় আর রিদার দিকে তাকায়। রিদা তাদের হাত বাড়িয়ে ডাকে। ছানা ̧গুলো এখনও উড়ে রিদার কাছে যাওয়ার সাহস করতে পারে নি! দুইদিন পর রিদা প্রথম কাকের ডাক শুনতে পায়। জানালায় দাঁড়াতেই শোনে কাকের ছানার বাবা-মা ডাকছে আর তা শুনে ছানা দুটো সেভাবে ডাকার চেষ্টা করছে।বাবা-মা ডাকে, কা-আ! কা-আ! ছানা দুটো ডাকে, কাক্কা! কাক্কা!
রিদা হেসে ওঠে। ওরাও তার মতো করে ডাকে! সে যেমন বাবাকে বাব্বা, দাদাকে দাদ্দা ডাকে, কাকের ছানা দুটোও তেমন ডাকছে কাক্কা! কী অদ্ভুত মিল তাদের! বাবা-মা আবার ডাকে, কা-আ! কা-আ!ছানা দুটো আবারও ডাকে, কাক্কা! কাক্কা!
এরপর আর তারা বাবা-মার ডাকের অপেক্ষা করে না, নিজের মতো ডাকতে থাকে, কাক্কা! কাক্কা!ডাকতে ডাকতে রিদার দিকে ঘুরে তাকায়। রিদাও হাত বাড়িয়ে ডাকে, কাক্কা! কাক্কা!রিদার ডাকে কাকের ছানা দুটো এক ঝটকায় উড়ে এসে প্রথমে জানালার গ্রিলে বসে। তারপর লাফ দিয়ে রিদার ঘাড়ের ওপর বসে। দুটো ছানা দুই ঘাড়ে। রিদা অবাক হয়ে যায়। সত্যি সত্যি ছানা দুটো তার ঘাড়ে বসে আছে! ছানা দুটোও এতদিন অপেক্ষায় ছিল রিদার কাছে আসার জন্য। তারা আনন্দে ডেকে ওঠে, কাক্কা! কাক্কা!
রিদা ছানা দুটোকে হাত দিয়ে ̄স্পর্শ করে! কী কোমল, তুলতুলে! সে ছানা দুটোর লম্বা ঠোঁটে চুমু দেয়। ছানা দুটোও তাদের লম্বা ঠোঁট দিয়ে রিদার গালে আলতো করে ঠোকর দেয়! রিদা জানালা থেকে ছুটে চলে যায় বাসার ভেতরে! আম্মার সামনে যেতেই সে চমকে ওঠে, চোখ বড় বড় করে বলে, তোমার ঘাড়ে ও ̧লো কী, মামণি! রিদার উচ্ছ্বসিত উত্তর, কাক্কা! কাক্কা! রিদাকে সমর্থন দিতে কাকের ছানা দুটোও ডেকে ওঠে, কাক্কা! কাক্কা! এমন ডাক শুনে ছুটে আসে বাবা আর দাদাও। তারাও অবাক হয়ে যায় দেখে।
আম্মা একটু এগিয়ে গিয়ে আহ্লাদ করে বলে, ও তাই! ওরা কাক্কা! রিদা মিষ্টি হেসে চোখ নাচিয়ে মাথা নাড়ায়। তারপর পুরো বাসায় ছুটে বেড়ায় আর ডাকে, কাক্কা! কাক্কা! কাকের ছানা দুটোও সুর মেলায়, কাক্কা! কাক্কা!
মুহসীন মোসাদ্দেক
বাড়ি নং ১৮ (৫ম তলা), রোড নং ১৪
নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা-১২২৯।
মোবাইল : ০১৭১৭৬৪৮০৫৯

0 মন্তব্যসমূহ